ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩০ বৈশাখ ১৪৩১
শিরোনাম

ডিপ্লোমাধারীদের বিএসসি’র মর্যাদা দিলেই কি শিক্ষার মান বাড়বে?

  গোলাম জিলানী, সমাজকর্মী ও উন্নয়ন বিশ্লেষক

-

প্রকাশ :  ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০১:১৬ দুপুর

দেশের উন্নয়নে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রচার ও প্রসারের বিকল্প নেই। জনমিতিক লভ্যাংশ অর্জন ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবেলায় তরুণ জনগোষ্ঠীকে আন্তর্জাতিক মানের দক্ষতা প্রদান খু্ব জরুরি। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তরুণ ও যুবসমাজের বাজার চাহিদার সাথে সম্পৃক্ত দক্ষতা বৃদ্ধি নিয়ে কাজ করছি। ফলে বাংলাদেশের কারিগরি ও সাধারণ বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করছে এমন তরুণদের সম্পর্কে কিছু বাস্তব ধারণা পেয়েছি। কাজ করতে গিয়ে অনেকের সাথে সখ্যতাও হয়েছে।

অভিজ্ঞতা নিয়ে বাংলাদেশের সাবেক একজন ক্রিকেট কোচের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। আমার যতোটুকু মনে পড়ছে জেমি সিডন্স দায়িত্ব পাওয়ার পর যখন সিনিয়র ক্রিকেটারদের দল থেকে বাদ দিয়ে নতুনদের সুযোগ করে দেন তখন তিনি ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হন। সে সময়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘শুধু অভিজ্ঞতা থাকলেই হবে না সামর্থ্যও থাকতে হবে’। বাংলা প্রবাদও রয়েছে, মানুষ বেচে থাকে তার কর্মের মাধ্যমে, বয়সে নয়। কবি সুকান্ত একুশে গত হলেও তিনি তাঁর কর্মের মাধ্যমে আজও স্মরণীয়, ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

অনেক ক্ষেত্রে বয়সের কারণে যে অভিজ্ঞতা হয় তা বাস্তব জীবনে পুরোপুরি কার্যকর নাও হতে পারে, যদি না তার সাথে বাস্তব দক্ষতা ও পরিবর্তিত মনোভাবের সংমিশ্রণ ঘটে। শুধু বয়স বা অভিজ্ঞাকে যদি গণ্য করা হয় তবে অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রধানকর্তা ব্যক্তির থেকেও অফিস সহায়কের অভিজ্ঞতা বেশি থাকতে পারে, তার মানে কি তিনি তার কর্তার স্থলাভিষিক্ত হবেন?

এখানে প্রয়োজন জ্ঞান ও দক্ষতা যা অর্জন করতে হয় সুদীর্ঘ শিক্ষণ, প্রশিক্ষণ, প্রত্যক্ষণ ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। এটি মোটেও সহজ কোনো বিষয় নয়! সম্প্রতি বাংলাদেশে চার বছর মেয়াদি কারিগরি বিষয়ে ডিপ্লোমাধারীদের বিএসসি (পাস) এর সমমান দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হতে একটি কমিটি গঠন করে প্রজ্ঞাপনও জারি করা হয়েছে। এতে ধারণা করা যায় যে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় হয়তোবা এ বিষয়ে ইতিবাচকই ভাবছে। যদি সত্যি সত্যি ডিপ্লোমাধরীদের বিএসসি (পাস) এর মর্যাদা দেওয়া হয় তাহলে কতিপয় বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা প্রদান করা প্রয়োজন। নতুবা জনমনে বিভ্রান্ত তৈরি হতে পারে, বিএসসি ডিগ্রিধারীদের মনে ক্ষোভেরও তৈরি হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

১) কারিগরি বিষয়ে ডিপ্লোমাধারী ব্যতীত আরও যে সকল বিষয়ে তিন/চার বছরের ডিপ্লোমা চালু ছিল/আছে তাঁদের কি হবে, তাঁরা কি তাঁদের সম্পর্কিত বিষয়ের উচ্চতর ডিগ্রিধারীর সমমান পাবে?

যেমন ডিপ্লোমা নার্স বা স্যাকমোগণ কি চাকুরির দুই বছর পর যথাক্রমে বিএসসি নার্সিং এবং এমবিবিএস এর সমমান পাবে, শুনতে হাস্যকর লাগছে! তাঁদের দাবি কি অযৌক্তিক হবে? তদ্রূপ কৃষি বিষয়ে ডিপ্লোমাধারীগণ কীসের সমমান হবে? কৃষি বিষয়ে বিএসসি’র সমমান! এ সকল প্রশ্নের উত্তর জানা জরুরি!

২) ডিপ্লোমাধারীগণ দুই বছর চাকরি করার পর নিয়মিতভাবে যারা বিএসসি পাশ করেছে তাঁদের মতো কি একই পদের চাকরির জন্য উপযুক্ত হবে? সুপারভাইজার বা ঊর্ধ্বতন সুপারভাইজার কীভাবে নির্ধারণ হবে, দক্ষতা নাকি শুধু অভিজ্ঞতা গুরুত্ব পাবে, তা নিয়েও দ্বন্দ্ব হতে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। 

৩) ডিপ্লোমাধারীগণ কি নিয়মিতভাবে বিএসসি ডিগ্রিধারীদের স্থলাভিষিক্ত হবে? তাদের দক্ষতা মান কি হবে? দক্ষতা মান কি নিয়মিত বিএসসি ডিগ্রিধারীদের সমমান হবে নাকি যা আছে তাই থাকবে?

বর্তমানে যে সিলেবাস প্রচলিত আছে তার সাথে বিএসসি’র সিলেবাসের যে যোজন যোজন পার্থক্য আছে অন্তত তা বুঝার জন্যে বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই।

৪) ডিপ্লোমাধারীগণকে বিএসসি’র সমমান দেওয়া পক্ষান্তরে উচ্চ শিক্ষাকে নিরুৎসাহিত করার সামিল। এটি গবেষণাকে নিরুৎসাহিত করবে। বর্তমান ডিপ্লোমা কারিকুলামে কি গবেষণার সুযোগ আছে? এসএসসি’র পর চার বছরের ডিপ্লোমার উদ্দেশ্য আর নিয়মিত বিএসসি ডিগ্রি প্রদানের
উদ্দেশ্য কখনো এক নয়। ডিপ্লোমাধারীগণ মিড লেভেলে কাজ করে, পক্ষান্তরে বিএসসি ডিগ্রিধারীগণ তুলানমূলকভাবে উচ্চতর পর্যায়ের জঠিল বিষয় নিয়ে কাজ করে। বিশেষজ্ঞগণ এ বিষয়ে
নিশ্চয়ই ভালো জানবেন। কেউ যদি বলে প্রাথমিক শিক্ষার পর চাকরিতে প্রবেশ করে পর্যায়ক্রমে স্নাতক, স্নাতকোত্তর বা পিএইচডি ডিগ্রি প্রদানে সমস্যা কোথায়? এ প্রশ্নের উত্তর জানা নেই।

৫) একই বিতর্ক উঠবে জেনারেল লাইনে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পাশ করে দুই বছর চাকরি করার পর কিসের সমমানের হবে, স্নাতকধারীগ্ণ কি স্নাতকোত্তর, স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীগ্ণ কি পিএইচডি এর সমমান হবে?? আর যদি না হয় তাহলে এটা কী বৈষম্য সৃষ্টি করবে না?

জেনারেল বিষয়ে ডিগ্রিধারীগণ যদি দাবি জানায় তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কি পদক্ষেপ নিবে, কোন যুক্তিতে তা
প্রত্যাখ্যান করবে, আইনগত ভিত্তিই বা কি হবে?

৬) ডিপ্লোমাধারীদের প্রদেয় বিএসসি (পাস) কি অনারারি ডিগ্রির মতো হবে, নাকি নিয়মিত ডিগ্রি হিসেবে বিবেচিত হবে? যদি তাই হয় এটা কি তাদের জন্য সম্মানজনক হবে কিংবা আদৌ কোনো গুণগত পরিবর্তন নিয়ে আসবে নাকি একটা বিশেষ গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করার প্রচেষ্টা মাত্র?

৭) এটি কি এরকম নয় যে, একজন পরীক্ষা দিয়ে ন্যূনতম পাশ নম্বর পেলো, আরেকজন পরীক্ষা না দিয়েই প্রথম বিভাগ পেলো। এর মাধ্যমে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা পাবে নাকি অসন্তোষ তৈরি হবে, নাকি এডহকধারীদের মতো হবে? একসময় তাঁরা নিয়মিতদের থেকেও এগিয়ে যাবে। এটা সুশাসন ও ন্যায্যতার পরিপন্থি বলেই আমার কাছে মনে হয়।

৮) এ প্রক্রিয়া কি যারা নিয়মিত বিএসসি ডিগ্রিধারী তাদেরকে খাটো করবে না, নিরুৎসাহিত করবে না? স্বীকৃতি দিলেই কি মানের পরিবর্তন হবে? বরং বর্তমান অবস্থায় রেখে ডিপ্লোমাধারীদের দক্ষতা বাড়ানো জরুরি, ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। এ সকল প্রশ্নের যথোপযুক্ত উত্তর পাওয়া কি সম্ভব হবে? 

৯) যারা ডিপ্লোমা করার পর বিএসসি ডিগ্রি সম্পন্ন করেছে তাঁরা কি এ প্রক্রিয়া মেনে নেবে, ডিপ্লোমার পর যারা দুই বা ততোধিক বছর চাকরি করেছে এবং সেই সাথে আবার বিএসসি সম্পন্ন করেছেন তাঁরা কিসের সমমানের হবে? ধরে নেয়া যাক তারা বিএসসি (সম্মান) এর সমমান কিন্তু সুযোগ-সুবিধা একই। এটা কী তাদের সাথে বৈষম্য নয়?

১০) এ রকম সিদ্ধান্ত শিক্ষার বাণিজ্যকে প্রসারিত করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই, নামে মাত্র শিক্ষা প্রদানকারী অখ্যাত ইনস্টিটিউটসমূহ এসএসসির পর নানাবিধ প্রলোভন দেখিয়ে শিক্ষার্থী টানার চেষ্টা করবে ।

ডিপ্লোমাধারীদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ এবং চাকরিতে ন্যায্যতার ভিত্তিতে সম্মান ও সমমান প্রদান করা একান্ত জরুরি। এ লক্ষ্যে ভেবে-চিন্তে এগুনোই দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে।

এক্ষেত্রে কতিপয় বিষয় বিবেচনায় নিলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। যেমন: ডিপ্লোলাধারীদের উচ্চ শিক্ষার (বিএসসি’র) সুযোগ তৈরি করে দেয়া এবং প্রয়োজনে সরকার বা চাকুরিদাতা প্রতিষ্ঠান হতে উচ্চশিক্ষার লক্ষ্যে বৃত্তির ব্যবস্থা করে দেয়া।

ডিপ্লোমাধারীদের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় নির্দিষ্ট কোর্সওয়ার্ক ও প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করার পর যথাযথ মূল্যায়ন সাপেক্ষে স্নাতক (পাস) ডিগ্রি প্রদান। এতে করে তাদের জ্ঞান, দক্ষতা ও মনোভাবের ইতিবাচক পরিবর্তন হবে।

পেশাগত বৈষম্য ও দক্ষতার ঘাটতি লাগব হবে বলে আশা করা যায়।  নির্ধারিত সময়ের পর কর্মদক্ষতা মূল্যায়ন সাপেক্ষে ডিপ্লোমাধারীদের পদোন্নতির সুযোগ সৃষ্টি করা। সুনির্দিষ্ট ক্যারিয়ারের পথ সুগম করা এবং ডিপ্লোমা ডিগ্রিকে সমাজে সম্মানজনক পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি।

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মান নিয়ে এমনিতেই নানাবিধ প্রশ্ন রয়েছে। স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পরেও শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এ নিয়ে অভিভাবক মহলের তীব্র অসন্তোষও মাঝে মধ্যে দেখা যায়। ডিপ্লোমাকে বিএসসি এর সমমান প্রদান করা হলে নতুন করে বিতর্ক শুরু হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শিক্ষাব্যবস্থাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে যা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত হবে তার মানে ও গুণে, ডিপ্লোমাকে বিএসসি এর সমমান ডিগ্রি হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করলেই শিক্ষার মানোন্নয়ন হবে না এটা৷ নীতিনির্ধারকদের বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। 

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত